দ্বিতীয় অধ্যায়ে তোমরা পানিদূষণ সম্পর্কে জেনেছ। মাটিদূষণ আর পানিদূষণ একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ পানিদূষণের জন্য যেসব কারণ দায়ী, সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাটি দূষণেরও কারণ। এখন তাহলে আমরা মাটিদূষণের নির্দিষ্ট কিছু কারণ জেনে নিই।
শিল্প-কারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য
তোমরা কি জান, আমাদের দেশে শিল্প-কারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য কী করা হয়? বেশির ভাগ সময় শিল্প-কারখানা ও শহরাঞ্চলের গৃহস্থালির বর্জ্য মাটির নিচে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয় বা কখনো কখনো একটি খোলা জায়গা বা ডাস্টবিনে জড়ো করে রাখা হয়। গ্রামাঞ্চলে প্রায় সব সময়েই বাড়ির আশপাশেই জঞ্জাল ফেলা হয়। এসব বর্জ্যের পচনশীল দ্রব্যগুলো জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পচতে থাকে এবং জৈব সারে পরিণত হয়। তোমরা কি ধারণা করতে পার এই জাতীয় দূষণের ফলাফল কেমন হতে পারে? যেহেতু শিল্প-কারখানার বর্জ্যে মারকারি, জিংক, আর্সেনিক ইত্যাদি থেকে শুরু করে এসিড, ক্ষার, লবণ, কীটনাশক—এ ধরনের হাজারো রকমের মারাত্মক ক্ষতিকর পদার্থ থাকে, তাই এই জাতীয় দূষণের প্রভাবও হয় বহুমাত্রিক। যেমন: মারকারি আর অন্যান্য ধাতব পদার্থ মাটিতে বিদ্যমান উপকারী অণুজীবগুলোকে মেরে ফেলে, যার ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। আবার মাত্রাতিরিক্ত লবণ, এসিড বা ক্ষার গাছপালা আর ফসলের ক্ষতি করে। এই জাতীয় বর্জ্যে থাকা প্রোটিন বা অ্যামিনো এসিড ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা ভেঙে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস, সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস কিংবা ফসফরাসের অক্সাইড তৈরি করে, যার কারণে মাটি দূষিত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হচ্ছে, এ ধরনের দূষণের ফলে ক্ষতিকর পদার্থ মাটি থেকে খাদ্যে এবং খাদ্য থেকে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদেহে প্রবেশ করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এই জাতীয় দূষণের ফলে মাটির জৈব রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন ঘটতে পারে, যেটি ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
তেজস্কির পদার্থের নিঃসরণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে দুর্ঘটনা বা পরীক্ষা- নিরীক্ষার ফলে বের হয়ে আসা তেজস্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে মাটির মারাত্মক দূষণ হতে পারে। রেডন (Rm), রেডিয়াম (Ra), ঘোরিয়াম (Th), সিজিয়াম (cs), ইউরেনিয়াম (U) ইত্যাদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ শুধু যে মাটির উর্বরতাই নষ্ট করে তা নয়, এরা প্রাণীদেহের ত্বক ও ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার ফলে গাছপালাও মরে যায়। এছাড়া অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের মতো এরাও খাদ্যশৃংখলের মাধ্যমে প্রাণীদেহে প্রবেশ করে ভয়াবহ রোগ সৃষ্টি করে।
তোমরা কি চেরোনোবিল দুর্ঘটনার কথা জান?
দলগত কাজ
কাজ: চেরোনোবিল দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে এর ভয়াবহতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
অতিরিন্ন গলি থেকে মাটিদূষণ নদীভাঙনের কথা তোমরা সবাই জান। নদী ভাঙনের ফলে নদীর পাড় ভাঙা মাটি বা অন্য কোনোভাবে সৃষ্ট মাটি কিংবা পানিতে অদ্রবণীয় পদার্থ পানির সাথে প্রবাহিত হরে একপর্যায়ে কোথাও না কোথাও তলানি আকারে জমা পড়ে। এগুলো কখনো নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদির তলদেশে জমা হতে পারে আবার কখনো ফসলি জমির উপর জমা হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সমস্ত তলানিতে নানারকম ক্ষতিকর পদার্থ থাকতে পারে। এই জাতীয় ভলানি ফসলি জমির ওপর পড়লে সেটি জমির উপরিভাগ, যা ফসল উৎপাদনে মূল ভূমিকা পালন করে, তার ওপর একটা আস্তরণ তৈরি করে। ফলে এই জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। এসব পদার্থ নদীগর্ভে জমা হলে কী হয় তা তোমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইতিমধ্যে জেনে গেছ।
খনিজ পদার্থ আহরণের দ্বারা মাটির দূষণ
খনি থেকে মূল্যবান খনিজ পদার্থ বা তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের সময় প্রচুর মাটি খনন করে সরিয়ে ফেলতে হয়। এতে যেমন বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলহানি ঘটে, ঠিক তেমনি মাটিদূষণের ফলে মাটির উর্বরতাও নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় এর ফলে সৃষ্ট মাটি ক্ষয়ের কারণে তা আশপাশের জলাভূমি ভরাট করে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
অনেক খনিই বন এলাকায় থাকে, যে কারণে খনি খননের কারণে বনজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। যার ফলে ঐ সকল স্থানে মাটিদূষণ ঘটে। এছাড়া খনিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা (যা সচরাচর ঘটেই চলেছে) ঘটলে তা আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটির উৎপাদনশীলতা নষ্ট করে দিতে পারে।
এছাড়া অতিরিক্ত সার, কীটনাশক, আগাছা ধ্বংসকারী দ্রব্যাদি, গাছপালার অবশিষ্টাংশ, প্রাণিজ বর্জ্য, মাটির ক্ষয় এমনকি কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলেও মাটিদূষণ হয় এবং মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়।মানুষের মলমূত্র, পাখির বিষ্ঠা বা অন্যান্য প্রাণীর মলমূত্র থেকে কি মাটিদূষণ হতে পারে? হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। কারণ, এসব মলমূত্রে রোগ সৃষ্টিকারী নানারকম জীবাণু থাকে, যারা মাটিতে বেড়ে উঠে এবং পরবর্তী সময়ে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে রোগ সৃষ্টি করে।
Read more